২৩ জুল, ২০১৪

আমার স্কুলের স্মৃতি


বৃষ্টির গন্ধে মন কানায় কানায় ভরপুর। মনে পড়ে যায় স্কুলের বনমহোত্সবের কথা। নামকরা মেয়েদের স্কুল ।

স্কুলের নাম : বরানগর রাজকুমারী মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল

ঠিকানাঃ ২ এবং ৩ শশীপদ ইনস্টিট্যুট লেন

কলকাতা ৭০০০৩৬



মফঃস্বলের স্কুল কিন্তু পুরোণো কোলকতার মেয়েদের স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম । মেয়েদের স্কুলে এখানেই প্রথম চালু হয়েছিল বিজ্ঞান শাখা । আর ছিল কেতাদুরস্ত ল্যাবরেটারি । লাইব্রেরীতেও ছিল বিশাল ব‌ইয়ের সম্ভার । ছিল খেলার মাঠ । একটা প্রকান্ড চেরী গাছ, আর ছিল ডালিম,জামরুল আর আতাগাছ । বড়দির ঘরের পেছনে ছিল লিলিপুল । মাঠের একদিকে গ্রিণ হাউস । অনামা সব ফুলেল ক্যাকটাস থাকত সেই গ্রিণহাউসে। স্কুলের দুটো গেট । একটা কেবল সকালে খুলত প্রাথমিক সেকশানের জন্য আর দুপুরে খুলত দুটোই । দুই গেটের মাথায় জুঁইফুল গাছের আর্চ আর গেট পেরিয়ে স্কুল অফিসে ঢোকার মুখে দুপাশে গোলাপের কেয়ারি । কি সুন্দর পরিবেশ !
স্কুলের দুটো বিল্ডিং । একটা পুরোণো আর একটা নতুন । পুরোণো বিল্ডিংয়ে সকালবেলায় প্রাইমারীর ক্লাস হয় আর দুপুরে সেকেন্ডারির । নতুন বিল্ডিংয়ে হায়ার সেকেন্ডারির ক্লাস হয় আর সেই সাথে ল্যাব, অফিস সব চলতে থাকে । দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে বেশ কিছুটা জমি আছে স্কুলের । সেখানটা বন্ধ । ছোট্ট একটা গেটও আছে এবাড়ি থেকে ওবাড়ি যাবার ; টিফিনের সময় ফুচকা-আলুকাবলি ওয়ালারা ঐ গেটের কাছটাতেই হেলান দিয়ে বিক্রি করে সব । কিন্তু সেই গেটটা সচারচর খোলা থাকেনা । ছুটির দিনে বোধ হয় মালি গিয়ে সেই জমির আগাছা সাফ করে আসে ।
ঐ জায়গাটায় একটা ফ্যামিলি সেমেটরি । স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা খ্রীষ্টান ছিলেন। রাজকুমারী দেবীর স্মৃতি রক্ষায় ঐ স্কুল।
ওনাদের পরিবারের সকলের কবরখানা ঐটে ।
ওনার ভাই বোনেদের ও কত ছোট ছোট সব ক্রস দেওয়া সিমেন্টের বেদী করা রয়েছে । ভালো করে দেখলে ওনাদের পুরো ফ্যামিলি ট্রি টা লক্ষ্য করা যায় । কত ধূপের কাঠি আর মোমবাতির টুকরো পড়ে থাকত। আমরা টিফিন খেতাম সেখানে। ওনার নাকি খুব গাছপলার শখ ছিল । আর তাই তো প্রতিবছর বর্ষার সময় আমাদের স্কুলে বনমহোত্সব বা বৃক্ষরোপণ হয় ঘটা করে ।গ্রীষ্মের ছুটির পরেই বৃক্ষরোপণ উত্সবের তোড়জোড় চলত ।
দস্তুর মত রিহার্সাল চলত কমন রুমে । বনমহোত্সবের একটা স্ক্রিপট বছর বছর হয়ে আসছে । একটু রদ বদল করে কয়েকটা গান এদিক ওদিক করে নৃত্যনাট্য দাঁড় করানো হয়। সবুজ গাছ লাগানো হয় । খুব উত্সাহে মেয়েরা নাচ গান প্র্যাকটিস করে প্রতিবছর । অনুষ্ঠান শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের গান 'আয় আমাদের অঙ্গনে, অতিথিবালক তরুদল ' দিয়ে আর শেষ হয় 'মরুবিজয়ের কেতন ওড়াও, এ শূন্যে ওড়াও ওড়াও হে প্রবল প্রাণ' দিয়ে । প্রথম দৃশ্যে একদল মেয়ে নেচে নেচে মঞ্চে এসে প্রবেশ করে আর শেষ দৃশ্যে তারাই আবার প্রত্যেকে হাতে একটা করে সবুজ চারা গাছ নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসে খোলা স্কুল মাঠের ধার দিয়ে নেচে নেচে চলে । গাইতে থাকে বাকি সকলে যারা এতক্ষণ ধরে গান পরিবেশন করছিল । নাচের মেয়েদের মেঘ রংয়ের শাড়ি আর সবুজ উড়নি মাথায় । গানের মেয়েরা কচিকলাপাতা রঙের শাড়ি আর মেঘ নীল ব্লাউজে । আগে থেকে স্কুলের মালি যেখানে যেখানে নতুন গাছ পোঁতা হবে তার জন্য মাটি খুঁড়ে নির্দ্দিষ্ট ব্যাবধানে গর্ত করে রাখে । নাচের মেয়েরা নাচ করতে করতে একে একে গাছগুলি সেইখানে রেখে দেয় আর গানের মেয়েরা জলঝারি দিয়ে জল দান করে সেই নতুন গাছের চারায় । এভাবেই হয়ে আসছে বছরের পর বছর ।


আমার রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা স্কুল দিয়েই শুরু। ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে, এক আকাশের তলায গীতবিতানের ছন্দে গন্ধে মুখর হয়ে উঠত তিনটে মাস। কিশোরী হৃদয়ে মেঘের ডমরু, আসন্ন শরতের জন্য উশখুশানি আর পড়াশুনোর ভার তো ছিল‌ই। এখনো বর্ষায় রবীন্দ্রনাথকে আমার মত করে ফিরে পাই সেই বনমহোত্সবের গানে, কবিতায়। নিজের মনে আবৃত্তি করে উঠি.... ত্রস্তপায়ে চুপিচুপি চলে যাওয়া রাইকিশোরীর বনে-উপবনে অভিসার যাত্রার সাক্ষী হয়ে। আমার ভাবনাগুলো বর্ষার হাওয়ায় এখনো মেতে ওঠে মুকুলিত গাছের মত, কেঁপে ওঠে কচি কিশলয়গুলো, জলভেজা জুঁইয়ের গন্ধ, শ্রাবণের ধারার সাথে চুঁইয়ে পড়ে মনের কার্ণিশে।

photo courtesy: Google

কোন মন্তব্য নেই: